কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথার কারণগুলো কি? ব্যথা কোমর থেকে পা পর্যন্ত চলে যায়।, কোমর ব্যথার কারণ ও সমাধান, আপনারও কি মাঝে মাঝে কোমরে ব্যথা হয়? তাহলে এখনই সাবধান হয়ে যান, কেননা এটা হতে পারে নার্ভের সমস্যা। যদি নার্ভের সমস্যা হয়ে থাকে, ভবিষ্যতে আপনি হাঁটাচলা থেকে দূরে থাকতে পারেন। বিছানায় শুয়েও শান্তি পাবেন না। কোমরে ব্যথায় অস্থির হয়ে যাবেন। এজন্য একটু সাবধান হয়ে যান এখন থেকে।
আমি এই আর্টিকেল আপনাকে ভালোভাবে বুঝানোর চেষ্টা করব যে কোমর ব্যথাটা হওয়ার কারণ কি কি হতে পারে, এবং যাদের ব্যথা আছে, এই মুহূর্তে তারা কি ট্রিটমেন্ট করতে পারেন। আমি সেরা পাঁচটা ব্যায়ামের কথা আপনাকে বলে দেব এবং আপনাকে বলে দেব যে আপনার এই কোমর ব্যথাটা কেন হচ্ছে। আপনি বুঝতে পারবেন। ঠিক আছে, দেখে নিন।
কোমর ব্যথার কারণ
আপনি এই যে, আমাদের শরীরের মধ্যে নার্ভ থাকে। আমাদের ব্রেন পুরোটাই নার্ভ। এই ব্রেন থেকে যখন একটা স্পাইনাল কর্ড, আমাদের যে পিছনের মেরুদণ্ড, যাকে বলে থাকি, এর ভিতরের একটা দড়ির মতো, লম্বা একটা স্পাইনাল কর্ড বলে একটা নার্ভ থাকে। এটা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের বড় একটা পার্ট, যাকে স্পাইনাল কর্ড বলা হয়। এই স্পাইনাল কর্ড থেকে এভাবে সুতোর মতো পুরো শরীরের মধ্যে নার্ভ বেরিয়েছে। মেইন ব্রেন থেকে স্পাইনাল কর্ড, স্পাইনাল কর্ড থেকে প্রত্যেকটা ব্রাঞ্চ হয়ে পুরো শরীরে নার্ভ ছড়িয়ে গেছে।
যেমন, আমাদের ঘাড় থেকে এখানে ব্রাকিয়াল প্লেক্সাস, চার-পাঁচটা নার্ভ একসাথে জমে, আবার আমাদের দুটো হাতের মতো সাপ্লাই দিয়েছে নার্ভের সাপ্লাই। এবার, যখনই ঘাড়ের মধ্যে কোনো নার্ভের সমস্যা দেখা দেবে, হতে পারে আপনার হাতের দিকে ব্যথাটা চলে যাচ্ছে, আঙ্গুলে ব্যথা করছে। সেইম ভাবে, আপনার এই যে কোমরের পোর্শনটা, আপনার এল ফোর (L4), লাম্বার ভার্টিব্রা। আমি বাংলায় বুঝাচ্ছি আপনাকে। যদি অসুবিধা হয়, বলবেন।
লাম্বার স্পাইন ও সায়াটিক নার্ভ
আপনার যে কোমরের মেরুদণ্ডগুলো থাকে, এখানে নিচের দিকের মেরুদণ্ড, যেগুলো পাঁচটা থাকে, তাকে বলা হয় লাম্বার স্পাইন। এর মধ্যে এই চার নম্বর (L4) এবং পাঁচ নম্বর (L5) ভার্টিব্রা থেকে শুরু করে এস থ্রি (S3), স্যাক্রাম থ্রি পর্যন্ত। এই পার্ট থেকে লাল কালারের নার্ভগুলো বেরিয়েছে। এই সবগুলো নার্ভ বেরিয়ে এখানে এসে জমে এক হয়ে গেছে। এখান থেকে সেপারেটলি বেরিয়েছে, কিন্তু এখানে এসে এক হয়ে গেছে একটা নার্ভ হয়ে। এই নার্ভটাকে বলা হয় সায়াটিক নার্ভ। এটি বডির সবচেয়ে বড় এবং লম্বা নার্ভ।
যদি এখানে কোনো কারণে নার্ভের উপর চাপ পড়ে, তাহলে আপনার কোমর ব্যথাটা পায়ের দিকে নেমে যাবে। এটাকে বলা হয় রেডিয়েটিং পেইন। আমাদের কাছে যখনই কোনো রোগী আসে কোমর ব্যথা নিয়ে, আমরা প্রথমে জিজ্ঞেস করি, আপনার কোমর ব্যথাটা কি পায়ের দিকে নামছে? যদি নেমে থাকে, তাহলে ডান পায়ের দিকে নামছে, নাকি বাঁ পায়ের দিকে নামছে, নাকি দুটো পায়ের দিকে নামছে? এইটার উপর ভিত্তি করে আমরা ডায়াগনোসিসের প্ল্যান করি।
হার্নিয়েটেড ডিস্ক
একটা ভার্টিব্রা, মানে একটা হাড়। দুটো ভার্টিব্রার মাঝ বরাবর একটা ডিস্ক থাকে। এই ডিস্ক মানে একটা হালকা বেলুনের মতো, যার ভিতরে ফ্লুইড থাকে, যাকে বলা হয় নিউক্লিয়াস পালপোসাস। যখনই এই দুটো ভার্টিব্রার মধ্যে চাপ পড়বে, বা কোনো কারণে ইনজুরি, অতিরিক্ত ওজন নিয়েছেন, বেশি ঝুঁকে কাজ করছেন, কনস্ট্যান্ট বসে কাজ করছেন, বিভিন্ন কারণে এই ডিস্কটা চেপে যাচ্ছে। চেপে যাওয়ার কারণে ডিস্কটা এদিকে বেরিয়ে আসে বা হার্নিয়েটেড হয়ে যায়, মানে ফেটে যায়।
ফেটে গিয়ে নার্ভের উপর চাপ দেয়। যখন বাঁ দিকের নার্ভের উপর চাপ দেবে, তখন কোমর ব্যথাটা বাঁ পায়ের দিকে ছড়িয়ে যাবে। মনে হবে পায়ে ইলেকট্রিক শকের মতো ব্যথা হচ্ছে। এমনও হতে পারে, ডিস্কটা মাঝ বরাবর ফেটে গিয়ে ডান দিকেও চাপ দিচ্ছে, বাঁ দিকেও চাপ দিচ্ছে। ফলে ব্যথা দুই পায়েই ছড়িয়ে যেতে পারে।

অন্যান্য কারণ
- লাম্বার স্পাইন স্টেনোসিস: স্পাইনাল কর্ডের পিছনের অংশে স্টেনোসিস, মানে ন্যারো হয়ে যাওয়া। স্পাইনগুলো পাতলা হয়ে যায়, যার কারণে নার্ভের উপর চাপ পড়ে।
- মাসল এবং লিগামেন্ট ইনজুরি: মাসল টাইট হয়ে যাওয়া বা লিগামেন্টে ইনজুরি। ফ্লেভাম লিগামেন্ট থিকেন হয়ে স্পাইনাল কর্ডের উপর চাপ দিতে পারে।
- ডিজেনারেটিভ ডিস্ক: বয়সের সাথে ডিস্ক অ্যাবনরমাল রূপ ধারণ করে, যার কারণে নার্ভে কম্প্রেশন হয়।
- ট্রমা বা ইনজুরি: পড়ে গিয়ে, বাইক এক্সিডেন্ট, বা হাড় ভেঙে যাওয়ার কারণে নার্ভে কম্প্রেশন হতে পারে।
- স্যাক্রোইলিয়াক (SI) জয়েন্ট প্রবলেম: হিপ বোন এবং স্যাক্রাম বোনের মধ্যে জয়েন্টে ইনফ্লামেশন বা ইনফেকশনের কারণে ব্যথা হতে পারে।
ডায়াগনোসিস
কোমর ব্যথার কারণ জানার জন্য:
- এক্স-রে: এলএস স্পাইন এপি/ল্যাটারাল এক্স-রে করলে হালকা ধারণা পাওয়া যায়।
- সিটি স্ক্যান: আরেকটু ভালো ধারণা দেয়।
- এমআরআই: সবচেয়ে বেস্ট অপশন। এমআরআই করলে নার্ভের কম্প্রেশন পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এবং সঠিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করা যায়।
ট্রিটমেন্ট
ট্রিটমেন্ট নির্ভর করে সমস্যার তীব্রতার উপর:
- মিনিমাল সমস্যা: ওষুধ, পেইন কিলার, এবং ফিজিওথেরাপি দিয়ে ঠিক হয়ে যেতে পারে।
- সিরিয়াস সমস্যা: ল্যাপারোস্কপিক বা ওপেন সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
- মাইক্রো ডিস্কেকটমি: হার্নিয়েটেড ডিস্ক ঠিক করার জন্য।
- ল্যামিনেকটমি: ভাঙা হাড় রিমুভ করে নার্ভের কম্প্রেশন কমানো।
- ডাক্তার: নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জনের কাছে যান। গুগল সার্চ করে বেস্ট ডাক্তারের কাছে ভিজিট করুন।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন
- ভারী জিনিস তুলবেন না।
- বেশি সময় এক জায়গায় বসে থাকবেন না।
- অল্প হাঁটা-চলা করুন।
- সাইড হয়ে ঘুমান, যাতে স্পাইনে প্রেসার কম পড়ে।
- শক্ত ম্যাট্রেস ব্যবহার করুন। নরম ম্যাট্রেসে স্পাইনের ব্যালেন্স নষ্ট হয়, ব্যথা বাড়তে পারে।
সাপ্লিমেন্ট
একটা সিম্পল সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন, যেমন গ্লুকোসামিন। এটি জয়েন্টের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ায়, সাইনোভিয়াল ফ্লুইডের ব্যালেন্স রাখে, ইনফ্লামেশন কমায়, এবং কার্টিলেজকে শক্তিশালী করে। সকালে এবং রাতে খাওয়ার পর একটা করে খেতে পারেন।
সেরা পাঁচটি ব্যায়াম
এই ব্যায়ামগুলো হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্লিপ ডিস্কের জন্য উপকারী। সবসময় ধীরে ধীরে করবেন। যদি ব্যথা বাড়ে, সেই ব্যায়াম এড়িয়ে যাবেন।
- প্রোন প্রেসড আপ:
- উল্টো দিকে (প্রোন) শুয়ে এলবোর উপর চাপ দিয়ে স্পাইনকে রিভার্স করুন।
- 10 সেকেন্ড ধরে রাখুন, তারপর রেস্ট করুন।
- 10 সেট, সকালে এবং বিকেলে করুন।
- এক্সটেন্ডেড প্রোন প্রেসড আপ:
- দুই হাতের উপর ব্যালেন্স রেখে স্পাইনকে রিভার্স করুন।
- 10 সেকেন্ড ধরে রাখুন, 3-5 সেকেন্ড রেস্ট করুন।
- 10 সেট, সকালে এবং বিকেলে।
- লেগ রোটেশন:
- শুয়ে দুই পা ভাঁজ করুন।
- ডান হাত দিয়ে বাঁ পায়ের আঙ্গুল ধরে বাঁ দিকে রোটেট করুন, মাথা উল্টো দিকে রাখুন।
- 5-10 সেকেন্ড ধরে রাখুন, তারপর উল্টো দিকে করুন।
- 10 সেট, সকালে এবং বিকেলে।
- কাউ এন্ড ক্যাট এক্সারসাইজ:
- হাঁটু ও হাতের উপর ভর দিয়ে স্পাইনকে ভিতরের দিকে ঢুকান, মাথা উপরে তুলুন।
- তারপর স্পাইনকে বাইরের দিকে বাঁকান, মাথা নিচে নামান।
- 5-10 সেকেন্ড ধরে রাখুন, 10 সেট করুন।
- সিটিং স্পাইনাল স্ট্রেচ:
- সোজা হয়ে বসুন, স্পাইন সমান রাখুন।
- ধীরে ধীরে কোমর নিয়ে পায়ের মাঝে বসার চেষ্টা করুন, মাথা উপরে রাখুন।
- 5-10 সেকেন্ড ধরে রাখুন, 10 সেট করুন।
পরামর্শ
- যে ব্যায়ামে আরাম পাচ্ছেন, সেটি বেশি করুন।
- যে ব্যায়ামে ব্যথা বাড়ছে, সেটি এড়িয়ে যান।
- একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন। তারা আরও কার্যকরী পরামর্শ দিতে পারেন।
উপসংহার
আশা করি, এই আর্টিকেল আপনাদের অনেক ইনফরমেশন দিয়েছে। আমি চেষ্টা করব যথাসম্ভব ইনফরমেশন দিতে। এই আর্টিকেল আপনার পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করুন। ভালো থাকবেন, নিজের শরীরের যত্ন নিন। টাটা, বাই বাই।